ভাবের ঘরে চুরি
–রীণা চ্যাটার্জী
সুধী,
রোজ চলার পথে আজকাল মুর্তি বড়ো বেশি চোখে পড়ে। নানারকম প্রকল্পমূলক প্রতীকের মুর্তি- যেখানে উন্নয়ন দু’হাত বাড়িয়ে মুচকি হাসে। আছে পুরোনো দিনের বহুল পরিচিত মুর্তি- পুরোনো কলকাতাকে মনে রাখার, ধরে রাখার প্রয়াস। যদিও তিলোত্তমা রোজ ক্ষয়রোগের দীর্ঘশ্বাস ফেলে নীরবে। আছে মনিষীদের পরিচিত ভঙ্গীর মুর্তি। ভাবগম্ভীর দু’হাত আড়াআড়ি, মাথার পাগড়ি ঘাড় দিয়ে সামনে এসে পড়েছে, সুদুর প্রসারিত পাথুরে দৃষ্টি। আছে টাক মাথা, হাতে লাঠি, চোখে চশমা, হেঁটো ধুতিতে হন্তদন্ত হয়ে হাঁটার এক পা এগিয়ে রাখা মুর্তি। তারপর পুরানের রথী-মহারথী তাঁদের সারথী, হাতি, ঘোড়া সবকিছু নিয়ে যে যেমন জায়গা পেয়েছে, জাঁকিয়ে বসেছে ফুটপাতে, রাস্তার মোড়ে। কিন্তু বড়ো উঁচুতে, কাকপক্ষী নাগাল পায় অতি অনায়াসে। রোজ বাহ্যে-আহ্নিক সেরেও যায় সন্ধ্যায়-প্রত্যুষে। মানুষ শুধু মনে করে দিনক্ষণ দেখে। চাঁদা তুলে মালা, ধূপকাঠি জোগাড় করে ঝেড়ে, ফুঁকে পরিস্কার করে, অতিথি বরণে আর মাইকের অতিশব্দময় ব্যঞ্জনায় এলাকাবাসীর শান্তির দড়িতে টান দিয়ে মনে করিয়ে দেয় নির্জীব মুর্তির পিছনে তাদের সজীব অস্তিত্ব।
হঠাৎ মুর্তির কথা অপ্রাসঙ্গিক মনে হতেই পারে। কিন্তু সত্যিই কি অপ্রাসঙ্গিক? এক একটা মুর্তি যেন কোনো কোনো সময় মনের গভীরে নাড়া দিয়ে যায়। স্বামীজির পাথুরে দৃষ্টি বলে দেয় অন্তঃসারশূন্যতার কথা। আমরা তাঁর কথা বুঝিনি, বুঝতে চাইনি, শুধু তাঁর অবয়বের প্রচার কাজে লাগিয়েছি, তাই তো তাঁর বাণী, তাঁর ভাবনা সব বিকাশের ভান করে দাঁড়িয়ে আছে, নাহলে হয়তো ওই দৃষ্টি পাথুরে প্রতীক না হয়ে যুবসমাজের চোখে ষ্ফুলিঙ্গ হয়ে উঠতো। গান্ধীজির মাথাটা বাঁচাতে কবে যেন কে একটা ছাতা লাগিয়ে দিয়েছিল- ব্যস দায়িত্ব শেষ, ভুলে গেছে। তার বিবর্ণ শতছিন্ন অবহেলার নীচে গান্ধীজি- দৃষ্টিকটু? প্রথম প্রথম মনে হলেও এখন মনে হয় কি অদ্ভুত মিল, আমাদের তাপ্পি মারা মানসিকতার সাথে ওই মুর্তিটার। আমাদের হেরে যাওয়া, হারিয়ে যাওয়ার জীবন্ত নিদর্শন। ব্যর্থতার পরিচয় দিতেই যেন দাঁড়িয়ে পড়েছেন রাস্তা ফুঁড়ে। দাঁড়িয়ে আছেন পরমহংসদেব, পাশে বসে মা সারদা, অন্য পাশে বসে স্বামীজি। তিনমুর্তি একসাথে- এরা বেশ নাগালের মধ্যে, ভালো ভাবে দেখাও যায়। কিন্তু বেমানান না! শুধু পরমহংসদেব দাঁড়িয়ে বাকি দুজন বসে.. মানীর মান! এ কিসের প্রতীক? যাই হোক শিল্পী বা পাড়ার দাদারা যেমন ভেবেছেন। আসি ভঙ্গিমার কথায়, আলোর বিকিরণ- বিচ্ছুরণ বোঝানোর মত দুই হাতে দুই ভঙ্গী রামকৃষ্ণের মুর্তিতে। ভাবখানা এই দিক দিয়ে এসে পড়লো, ওই দিকে বেরিয়ে গেল- চটজলদি। কি অদ্ভুত মিলে গেল আমাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবন ও ভাবনা। একটা বিতর্কের জন্ম হয়, চাপা দিতে আর একটা বিতর্কের সৃষ্টি করা হয়। আমজনতা মেতে ওঠে, একটার পর একটা ধরতে। বেশ ধামাচাপা পড়ে যায় আগের ঘটনা, নতুনটা নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি হলেই আরো একটা বিতর্ক বানাতে কতক্ষণ লাগে! আবার সময় মতো তুলে এনে তালুতে ফেললেই হল। সঙ্গে দোসর করোনা আর মিডিয়া- পরিস্থিতি হাতের বাইরে গেলেই করোনো বেড়ে যাবে, মিডিয়া ঘন্টায় ঘন্টায় ভয় দেখাবে “সীমা থেকে সীমানা” ছাড়িয়ে।
তাহলে কি আমরা মনীষীদের দেখানো পথেই চলেছি- নাহ্, শুধু ভান করছি আর ভাবের ঘরে চুরি করছি।
বৃষ্টি হচ্ছে, বর্ষাও ঘন্টা নাড়িয়ে এসেও গেছে- কিন্তু রেহাই নেই অস্বস্তির আর্দ্রতা থেকে। ঝলমলে আকাশ জুড়ে শরতের বাড়াবাড়ি। তবুও বর্ষামঙ্গল উপেক্ষা করার সাধ্য নেই। পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনা বৃষ্টির উচ্ছাস ও শুভেচ্ছা রইলো আলাপী মন-এর পক্ষ থেকে সকল শুভানুধ্যায়ীদের।
মন ছুঁয়ে যাওয়া নিবন্ধ। ভীষণ ভাল লাগলো।
প্রাপ্তি দাদাভাই 🙏
এত সচ্ছন্দগতি, সাবলীল গদ্য–এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম।চিন্তার গভীরতা লক্ষ্যণীয়।পাঠশেষে একটা অসহায়তার গ্লানি গ্রাস ক’রল।বড় ভালো লাগলো বিষয়বস্তু ও লিখনশৈলী।
প্রাপ্তি দাদাভাই 🙏